ধর্ম · রাজনীতি

গুনাহগার কেউ মরলে কি পড়বো? আলহামদুলিল্লাহ নাকি ইন্নালিল্লাহ?

আলহামদুলিল্লাহ নাকি ইন্নালিল্লাহ?

আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা বা বুদ্ধিজীবী পর্যায়ের কেউ মারা গেলেই দুটি দলের সৃষ্টি হয়। একদল ‘আলহামদুলিল্লাহ’ গ্রুপের, অন্যদল ‘ইন্নালিল্লাহ’ গ্রুপের। দুটি পক্ষই তাদের ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ও ‘ইন্নালিল্লাহ’ বলার পিছনে যথেষ্ট দলীল দেন।

সাধারণত অত্যাচারী সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের কেউ মারা গেলে জনগণ খুশি হয়, আলহামদুলিল্লাহ বলে। এর কারণ হলো, জনগণের শ্রমের টাকা ট্যাক্স হিসাবে সরকার গ্রহণ করে, কিন্তু সে টাকা জনগণের জন্য খরচ না করে নিজেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে যায়। জনগণ যখন নিজেদের টাকার হিসাব চায়, বা অধিকারের কথা বলে, তখন জনগণকে কারাগারে নিক্ষেপ করে এসব মন্ত্রী-এমপিরা। যেহেতু সরকারের অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা মানুষকে দেয়া হয় না, তাই সরকারের এমপি-মন্ত্রী-বুদ্ধিজীবী কেউ মারা গেলে খুব স্বাভাবিকভাবেই জনগণের মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। জনগণ নিজ থেকে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়তে থাকে।

জনগণের উপর অত্যাচার করলে বা জনগণের হক নষ্ট করলে, জনগণের ঘৃণা ও নিন্দা পাওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়। জনগণ যখন কারো মৃত্যুর পর সমালোচনা করে, তখন আল্লাহও সে সমালোচনা কবুল করে নেন। যেমন এক হাদীসে এসেছে –

আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কিছু সংখ্যক সাহাবী একটি জানাযার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁরা তার প্রশংসা করলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ওয়াজিব হয়ে গেল। একটু পরে তাঁরা অপর একটি জানাযা অতিক্রম করলেন, তখন তাঁরা তার নিন্দাসূচক মন্তব্য করলেন। (এবারও) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ওয়াজিব হয়ে গেল। তখন উমর ইবনে খাত্তাব (রা) আরয করলেন, (ইয়া রাসূলাল্লাহ!) কি ওয়াজিব হয়ে গেল? তিনি বললেন, এ (প্রথম) ব্যক্তি সম্পর্কে তোমরা উত্তম মন্তব্য করলে, তাই তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেল। আর এ (দ্বিতীয়) ব্যক্তি সম্পর্কে তোমরা নিন্দাসূচক মন্তব্য করায় তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেল। তোমরা তো পৃথিবীর বুকে আল্লাহর সাক্ষী। (বুখারী, ইফা, ১২৮৩)

এ হাদীস থেকে বুঝা যায়, খারাপ মানুষ মরলে সমালোচনা করা যায়, এতে সমস্যা না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব খারাপ মানুষ মারা গেলে কেউ যদি কোনো কারণে তাঁর মাগফিরাত চায়, তাহলে কি সমস্যা আছে?

উত্তর হলো – না। একজন লোক আমার শত্রু হতে পারে, কিন্তু অন্য মুসলিমদের বন্ধু হতে পারে, এটা দূষণীয় কিছু নয়। নিজের শত্রুকে সমস্ত মুসলিমদের শত্রু বানানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। যেমন হাদীসে এসেছে –

আবূ মূসা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক ব্যক্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কোনটি, কেননা আমাদের কেউ লড়াই করে রাগের বশীভূত হয়ে, আবার কেউ লড়াই করে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য।’ তিনি তার দিকে মাথা তুলে তাকালেন। বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর মাথা তোলার কারণ ছিল যে, সে ছিল দাঁড়ানো। এরপর তিনি বললেন: “আল্লাহর দ্বীনকে বুলন্দ করার জন্য যে যুদ্ধ করে সেই আল্লাহর রাস্তায়।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নম্বর : ১২৫)

এ হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, অনেকে ব্যক্তিগত শত্রুকে দমন করার জন্য জিহাদের নামে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়। কিন্তু সেটা জিহাদ হিসাবে কবুল করা হবে না। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক শত্রুকে সমস্ত মুসলিমদের শত্রু হিসাবে উল্লেখ করা, বা জিহাদের নামে তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা উচিত নয়।

উপরের হাদীসে আমরা দেখেছি, সাহাবীদের কেউ কেউ মৃত মানুষের বিষয়ে নিন্দাসূচক মন্তব্য করেছিলেন মাঝে মধ্যে, কিন্তু রাসূল (স) সর্বদা মৃত ব্যক্তিকে সম্মান করতেন। হোক সে ইয়াহুদি, মুশরিক বা মুনাফিক। নিচে তিনটি উদাহরণ দিচ্ছি।

জাবির ইবনে ‘আবদুল্লাহ্ (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাদের পার্শ্ব দিয়ে একটি জানাযা যাচ্ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম এবং নিবেদন করলাম, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! এ তো ইয়াহুদীর জানাযা। তিনি বললেন: তোমরা যে কোন জানাযা দেখলে দাঁড়িয়ে যাবে। (সহীহ বুখারী, ইফা, ১২৩৩)

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেছেন, রাসূল (স) মৃত ইয়াহুদি ব্যক্তির সম্মানে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন।

রাসূল (স) তাঁর মুশরিক চাচার জন্যেও দোয়া করেছিলেন। যখন রাসূলের চাচা ঈমান আনতে অস্বীকার করেছিলেন, তখন রাসূল স বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম! তবুও আমি আপনার জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকব, যতক্ষণ না আমাকে তা থেকে নিষেধ করা হয়।”(বুখারী, ইফা, ১২৭৭) এরপর আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাযিল করে রাসূল (স)-কে দোয়া করতে নিষেধ করেছেন।

এ ছাড়া বিখ্যাত মুনাফিকদের সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মারা যারার পরে উমর রা সহ অন্যান্য সাহাবীরা রাসূল (স)-কে মুনাফিকের জানাযায় যেতে বারবার বারণ করেন। তারপর রাসূল (স) মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, “উমর, সরে যাও! আমাকে (তার সালাত আদায় করার ব্যাপারে) ইখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। কাজেই আমি তা গ্রহণ করলাম। আমি যদি জানতাম যে, সত্তর বারের অধিক মাগফিরাত কামনা করলে তাকে মাফ করা হবে তা হলে আমি অবশ্যই তার চাইতে অধিক বার মাফ চাইতাম।”(বুখারী, ইফা, ১২৮২)

এরপর রাসূল (স) মুনাফিকের সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর জানাযা পড়ে আসেন। তখন আল্লাহ মুনাফিকদের জানাযা পড়তে নিষেধ করে আয়াত নাযিল করেন।

এখানে দেখুন, রাসূল (স)-এর স্বভাব ছিলো অমুসলিম মৃত ব্যক্তিকে সম্মান করা, মুনাফিক ও মুশরিকের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, ইত্যাদি। কিন্তু আল্লাহ নিষেধ করায় পরবর্তীতে আর ক্ষমা চাননি, কিন্তু কাউকে বদদোয়া, গালাগালি বা নিন্দা করেননি।এটাই রাসূলের সুন্নাহ।

এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট, দুই ধরণের লোকের জন্য রাসূলকে দোয়া করতে নিষেধ করা হয়েছে, তারা ছিলো (১) স্বীকৃত অমুসলিম এবং (২) আল্লাহর দ্বারা প্রমাণিত মুনাফিক। বর্তমানে স্বীকৃত অমুসলিমদের জন্যে সাধারণত কেউ দোয়া করে না। সমস্যা হয় মুনাফিক নিয়ে। গোনাহগার মুসলিমদেরকে অনেকে মুনাফিক বানিয়ে দেন। এরপর বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর জন্য যেমন দোয়া করতে নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি আমাদের অমুক নেতার জন্য দোয়া করা নিষেধ।

এখানে লক্ষণীয় যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর কথা আল্লাহ তায়ালা রাসূল (স)-কে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক নেতার কথা কিন্তু আমাদেরকে ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ জানান না। তাই আমরা নিশ্চিতভাবে কোনো মুসলিম রাজনৈতিক নেতাকে সরাসরি মুনাফিক বলতে পারি না। যদি আমরা আমাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদেরকে মুনাফিক বা কাফির বলতে থাকি, তাহলে আমাদের আর খারিজিদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না।

যেমন, আলী (রা)-এর হত্যাকারী ইবনে মুলজিম তার সহযোগী শাবীবকে বলেন – “তুমি কি দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভ করতে চাও? যদি চাও, তাহলে আলীকে হত্যা করতে হবে।।(বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭/৩৬১)

ইবনে মুলজিম যখন আলী (রা)-এর মাথায় তলোয়ার দিয়ে আঘাত করছিলো, তখনো সে জোরে জোরে কোর’আনের আয়াত তেলোয়াত করেছিলো। আলী (রা)-কে হত্যা করার সময়ে সে বলছিলো – “আল্লাহ ছাড়া কারোও হুকুম করার অধিকার নেই। হে আলী! তোমারও নেই এবং তোমার অনুসারীদেরও নেই”। হত্যাকারী তখন সূরা বাকারার ২০৭ নং আয়াত পড়ছিলো – “মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভার্থে আত্ম-বিক্রয় করে থাকে। আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র”

দেখুন, খারিজারা কিন্তু কোরআনের আয়াতকে দলীল হিসাবে প্রমাণ করেই আলী (রা)-কে হত্যা করেছিলো। আমরাও কোরআনের আয়াতকে দলীল হিসাবে নিয়েই আবার প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতাদেরকে মুনাফিক বা কাফির বলে গালাগালি করি। সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমাদের ও খারেজিদের মধ্যে কোনো অমিল নেই।

এ জন্য ইমাম আবু হানিফা বলেছেন –

ولا نكفر مسلما بذنب من الذنوب وإن كانت كبيرة، إذا لم يستحلها، ولا نزيل عنه اسم الإيمان. ونسميه مؤمنا حقيقة

“কোনো মুসলিমকে তার পাপের কারণে আমরা কাফির বলবো না, যদিও সে কবিরা গুনাহ করে; যতক্ষণ না সে তা হালাল মনে করে। এবং তার ইমান নেই, একথাও বলবো না, বরং তাঁকে প্রকৃত মুমিন হিসাবেই নাম দিব।” [আবু হানিফা, ফিকহুল আকবর]

ইমাম আবু হানিফার মতে, বর্তমানে কোনো মুসলিম কবিরা গুনাহ করার কারণে তাঁকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়া যাবে না, বা তাঁকে মুনাফিক-কাফির-ফাসিক বলা যাবে না। আমরা যারা অন্যকে গুনাহগার মুসলিম বলি, মুনাফিক-কাফির-ফাসেক বলি, তাঁরা কি বুকে হাত দিয়ে এ কথা বলতে পারবো যে, আমরা নিরপরাধ? আমাদের কোনো গুনাহ নেই?

কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় –

“এ পাপ-মুলুকে পাপ করেনি, করেনিক’ কে আছে পুরুষ-নারী?
আমরা ত ছার; পাপে পঙ্কিল পাপীদের কাণ্ডারী!
তেত্রিশ কোটি দেবতার পাপে স্বর্গ সে টলমল,
দেবতার পাপ-পথ দিয়া পশে স্বর্গে অসুর দল!
আদম হইতে শুরু ক’রে এই নজরুল তক্‌ সবে
কম-বেশী ক’রে পাপের ছুরিতে পুণ্য করেছে জবেহ্‌ !”
(পাপ, কাজী নজরুল ইসলাম)

যাই হোক, কম বেশি আমরা সবাই গুনাহ করি। কারো গুনাহ বা জুলুমের জন্য আমরা তাঁকে সমালোচনা বা নিন্দাও করতে পারি। কিন্তু নিন্দা করার যৌক্তিকতা খোঁজার জন্য কাউকে মুনাফিক বা কাফের বানানো যায় না। অথবা কেউ যদি কোনো গুনাহগার মুসলিমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে, তাহলে তাঁকে খারাপ বলা মানে খোদ রাসূলকে খারাপ বলা। কেননা, রাসূল এর কাছে আয়াত নাযিল হবার পূর্বে রাসূল (স) জেনে-শুনেই মুনাফিকের জন্য দোয়া করেছিলেন, বা মুশরিকের জন্য দোয়া করেছিলেন। আমাদের কাছে যেহেতু আয়াত নাযিল হচ্ছে না, তাই কেউ যদি কোনো গুনাহগার মুসলিমের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করে, তাহলে সেটা রাসূলের সুন্নাহ হিসাবেই গ্রহণীয় হবে।

সর্বশেষ একটি হাদীস দিয়ে শেষ করছি।

আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন: তোমরা মৃতদের গালমন্দ কর না। কেননা, তারা আপন কৃতকর্মের ফলাফল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। (বুখারী, ইফা, ১৩১১।)

মৃত মানুষের সমালোচনা করে আসলে কোনো লাভ নেই। কারণ সে আর নিজেকে সংশোধন করতে পারবে না। সমালোচনা যদি করতেই হয়, তবে জীবিত মানুষদের সমালোচনা করা উচিত।