দর্শন · ধর্ম · শিরোনামহীন · সাহিত্য

বাংলা সাহিত্যে “স্বামী-স্ত্রী” সমস্যা, এবং কোর’আনের সমাধান

পর্ব এক

‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দ জোড়াটি নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক আছে। এ শব্দ দুটি যেমন আপত্তিজনক, তেমনি বিপদজনকও বটে। বেগম রোকেয়া, ফরহাদ মজহার সহ অনেকেই এ শব্দগুলো নিয়ে আপত্তি তুলেছেন, বিতর্ক করেছেন এবং সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলেও সত্য যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দের সঙ্কট এখনো প্রকট।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দ জোড়াটি নিয়ে যদিও এখনো কেউ কোনো মীমাংসায় যেতে পারেনি, কিন্তু, আপনি ইচ্ছা করলেই কোর’আন থেকে ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দের সঙ্কট নিরসন করতে পারবেন।

প্রথমে আসুন, দেখা যাক, বাংলা সাহিত্যে ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দ জোড়াটি এবং এর সমর্থক শব্দগুলো কেন আপত্তিজনক?

বাংলা একাডেমীর অভিধানে, ‘স্বামী’ শব্দের অর্থ হলো – ১ প্রভু; মনিব; পতি; খসম; ভর্তা। ২ মালিক; অধিপতি। ৩ পণ্ডিত; সন্ন্যাসীর উপাধিবিশেষ।

এবং একই অভিধানে, ‘স্ত্রী’ শব্দের অর্থ হলো – ১ জায়া; পত্নী; বেগম; বিবি; বিবি; বধূ। ২ নারী; রমণী; কামিনী। ৩ মাদি।

সুতরাং, এখানে দেখতেই পাচ্ছেন যে, ‘স্বামী’ ও ‘স্ত্রী’ শব্দ দুটির মাঝে শব্দগত কোনো সাদৃশ্য নেই, অর্থের কোনো সঙ্গতি নেই, এবং মর্যাদাগত কোনো সমতা ও ভারসাম্য নেই।

অর্থাৎ, ‘স্বামী ও স্ত্রী’ শব্দ দুটির মাঝে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এক কথায় আকাশ-পাতাল ব্যবধান। স্বামীর স্থান আকাশের উপরে, আর স্ত্রীর স্থান পাতালের নিছে।

একটু চিন্তা করে দেখুন, ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দ জোড়াটি কিন্তু ‘দাদা-দাদী’ শব্দ জোড়াটির মত নয়।

‘দাদা-দাদী’ শব্দ জোড়াটির মাঝে যেমন শব্দের সাদৃশ্য আছে, তেমনি অর্থের সঙ্গতিও আছে। আছে মর্যাদাগত ভারসাম্য ও সমতা। কিন্তু ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দ দুটির মাঝে এমন কোনো সাদৃশ্য, সঙ্গতি, ভারসাম্য কিংবা সমতা নেই। – আপত্তিটা এখানেই।

বাংলা কবি-সাহিত্যিকদের প্রয়োজন ছিল, বিবাহ পরবর্তী নারী-পুরুষের জন্যে এমন দুটি শব্দের প্রচলন করা, যেখানে শব্দের সাদৃশ্য, অর্থের সঙ্গতি এবং মর্যাদাগত ভারসাম্য ও সমতা থাকে। কিন্তু আমাদের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির দুর্ভাগ্য যে, এখনো এমন কোনো শব্দের বহুল প্রচলন ঘটেনি।

অবশ্য, অনেকেই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন।

 

পর্ব দুই

‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দের সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে বাংলা সাহিত্যে অনেকেই কলম ধরেছেন, কিন্তু কেউ সফল হননি।

দুটি উদাহরণ দিচ্ছি।

বেগম রোকেয়া তাঁর ‘মতিচূর’ বইয়ের ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দ জোড়াটি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন, এবং সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি।

প্রথমে, তাঁর আপত্তি ও সমাধানটা হুবহু তুলে দিচ্ছি। দেখুন।

“…স্বীকার করি যে, শারীরিক দুৰ্ব্বলতাবশতঃ নারীজাতি অপর জাতির সাহায্যে নির্ভর করে। তাই বলিয়া পুরুষ ‘প্রভু’ হইতে পারে না।

…একজন ব্যারিষ্টার ডাক্তারের সাহায্য-প্রার্থী, আবার ডাক্তারও ব্যারিষ্টারের সাহায্য চাহেন। তবে ডাক্তারকে ব্যারিষ্টারের স্বামী বলিব, না ব্যারিষ্টার ডাক্তারের স্বামী? যদি ইহাদের কেহ কাহাকে ‘স্বামী’ বলিয়া স্বীকার না করেন, তবে শ্রীমতীগণ জীবনের চিরসঙ্গী শ্রীমানদিগকে ‘স্বামী’ ভাবিবেন কেন?

… শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ বলেন যে, আমাদের সাংসারিক জীবনটা দ্বিচক্র শকটের ন্যায়—ঐ শকটের এক চক্র পতি, অপরটি পত্নী। তাই ইংরাজী ভাষায় কথায় কথায় স্ত্রীকে অংশিণী (‘partner’) উত্তমার্ধ (‘better half’) ইত্যাদি বলে।

…আশা করি এখন ‘স্বামী’ স্থলে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দ প্রচলিত হইবে”।

বেগম রোকেয়া ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দ জোড়াটির পরিবর্তে ভিন্ন দুই জোড়া শব্দকে ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেছেন। এক – পতি ও পত্নী। দুই – অর্ধাঙ্গ ও অর্ধাঙ্গী। কিন্তু তাঁর প্রস্তাবিত এই শব্দগুলো অনেকটা সমস্যাজনক।

বাংলা একাডেমীর বাংলা অভিধানে পতি শব্দের অর্থ – ১ স্বামী। ২ প্রভু; কর্তা। ৩ পালক; রক্ষক; রক্ষাকর্তা। ৪ অধীশ্বর; অধিপতি; রাজা। ৫ নেতা; প্রধান ব্যক্তি; পরিচালক।

অন্যদিকে, পত্নী শব্দের অর্থ – জায়া; ভার্যা; বিবাহিত স্ত্রী।

বামন শিবরাম আপ্টের সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধানে ‘পতি’ শব্দের অর্থ কর্তা (a master, lord, যেমন গৃহপতি); অধিকারী, স্বত্বাধিকারী (an owner, possessor, proprietor, যেমন ক্ষেত্রপতি) শাসক (governor, ruler, one who presides over, যেমন ওষধীপতি, বনস্পতি, কুলপতি); স্বামী (a husband); গোড়া (a root); যাওয়া, গতি, উড়ান (going, motion, flight)।

দেখুন, ‘পতি ও পত্নী’ – এই শব্দ জোড়াটি মাঝে শব্দগত কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও অর্থের দিক থেকে এবং মর্যাদাগতভাবে এ শব্দ দুটির মাঝে অনেক বিশাল পার্থক্য রয়েছে। যেমন, ‘সভাপতি’ শব্দের স্ত্রী বাচক শব্দ ‘সভাপত্নী’ করা সম্ভব না; কিংবা ‘বিচারপতি’ শব্দের স্ত্রী বাচক শব্দ ‘বিচারপত্নী’ করা সম্ভব না। সুতরাং, আমরা দেখলাম, পতি ও পত্নী শব্দ দুটির মাঝে অর্থের আকাশ-পাতাল ব্যবধান।

এরপর আসুন, বেগম রোকেয়ার প্রিয় ‘অর্ধাঙ্গ ও অর্ধাঙ্গী’ শব্দ জোড়াটি লক্ষ্য করি। এটি একটি কৃত্রিম ও অযৌক্তিক শব্দ জোড়া। কারণ, বিয়ের আগের একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ বিয়ের পর একজন অর্ধাঙ্গ কিংবা অর্ধাঙ্গী হয়ে যেতে পারে না। শারীরিকভাবে এটা অসম্ভব।

হয়তো, দুটি অন্তর এক হয়ে যেতে পারে, কিন্তু দু’টি পূর্ণাঙ্গ শরীরের মানুষকে অর্ধাঙ্গ বা অর্ধাঙ্গী বানিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি করার চেষ্টা আদতে বৃথা ও অসম্ভব। কেবল যে শারীরিকভাবে নারী-পুরুষ দু-জন আলাদা, তা নয়; প্রত্যেক মানুষের চিন্তা-চেতনা ও ব্যক্তিত্ব-ও আলাদা থাকে – যতই হোক তারা অর্ধাঙ্গ বা অর্ধাঙ্গী।

সুতরাং, আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি, আক্ষরিক বা রূপক অর্থে, ‘অর্ধাঙ্গ-অর্ধাঙ্গী’ শব্দ দুটি দ্বারা ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দের সঙ্কট নিরসন হচ্ছে না।

আপনাদের কারো কারো হয়তো মনে হতে পারে, বেগম রোকেয়াকে নিয়ে আমি অতিরিক্ত বলেছি। কিন্তু না।

কবি ফরহাদ মজহার আমার চেয়েও একধাপ এগিয়ে গিয়ে ‘অর্ধাঙ্গিনী’ শব্দটির সমালোচনা করেন। তিনি তাঁর “কর্তৃত্ব গ্রহণ কর, নারী” কবিতায় লিখেন – “অর্ধসভ্য মানুষ তোমার নাম রেখেছে অর্ধাঙ্গিনী।” কিন্তু, আমি অন্তত বেগম রোকেয়াকে ‘অর্ধসভ্য’ বলতে চাই না।

তারপর দ্বিতীয় উদাহরণে আসুন। ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দ জোড়াটি এবং এর সমর্থক কিছু শব্দের সঙ্কট নিয়ে ফরহাদ মজহারের চেষ্টাটি লক্ষ্য করুন। প্রথমে তাঁর “কর্তৃত্ব গ্রহণ কর, নারী” কবিতার শেষ অংশটি পড়ুন।

“তোমার নাম হতে পারত মোগলাই পরোটা
তোমার নাম হতে পারত জাপানি হোন্ডা
তোমার নাম হতে পারত ডানহিল সিগারেট
তোমার নাম হতে পারত পুষিবিড়াল
অর্ধসভ্য মানুষ তোমার নাম রেখেছে অর্ধাঙ্গিনী

এইসব জেনে তোমার সামনে আমি
নতমুখে এসে দাঁড়িয়েছি, নারী
আমি পুরুষ
আমাকে ক্ষমা কর।
তুমি প্রজননযন্ত্র তাই তোমার নাম জননী
তুমি রমণযোগ্য তাই তোমার নাম রমণী
ঘোড়াশালে ঘোড়া হাতিশালে হাতির মতো মহলে মহলে থাকো
তাই তোমার নাম মহিলা
গৃহে গৃহে আসবাবপত্রের মত শোভা পাও
তাই তোমার নাম গৃহিণী
আমি পুরুষ শব্দের সমান অর্থবহ উচ্চারণে,
তোমার নামকরণ করতে চাই, নারী
কিন্তু পারি না
অক্ষম লজ্জায় আমি তোমার সামনে
অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছি
আমি পুরুষ
আমাকে ক্ষমা কর।

আজ আমি তোমাকে বলতে এসেছি
পুরুষ শব্দের অর্থ হচ্ছে কর্তৃত্ব
এবং তোমার কর্তৃত্ব গ্রহণ করার সময় হয়েছে, নারী
পুরুষকে গ্রহণ কর।”

ফরহাদ মজহার তাঁর কবিতায় ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দ জোড়াটি ব্যবহার না করে ‘নারী-পুরুষ’ শব্দ জোড়াটি ব্যবহার করতে চেয়েছেন। রমণী, মহিলা, গৃহিণী শব্দগুলোর পরিবর্তে পুরুষ শব্দের সমান অর্থবহ উচ্চারণে নারী শব্দটি তিনি প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু এর দ্বারা আমাদের উল্লেখিত সমস্যার কোনো সমাধান হয় না।

প্রথম কারণ হলো, পুরুষ ও নারী শব্দ দুটি কিছুটা সমান অর্থবোধক হলেও, এ শব্দ দুটির আকৃতিগত কোনো সাদৃশ্য নেই। এবং, এই শব্দ দুটির মাঝে কর্তৃত্বের বৈষম্যের কথা তো ফরহাদ মজহার নিজেই তাঁর কবিতায় উল্লেখ করেছেন।

দেখুন, ‘দাদা-দাদি’ বা ‘নানা-নানী’ শব্দ জোড়াগুলোর মাঝে যেমন শব্দের সাদৃশ্য, অর্থের সঙ্গতি এবং মর্যাদাগত সমতা খুঁজে পাওয়া যায়, ‘নারী-পুরুষ’ শব্দ জোড়াটির মাঝে তেমন কিছুই পাওয়া যায় না।

দ্বিতীয় কারণ হলো, বিবাহের পর নারী-পুরুষের মাঝে যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, এ শব্দ জোড়াটি সে ধরণের কোনো সম্পর্ক স্বীকার করে না। বিয়ের আগে ‘নারী-পুরুষ’ শব্দ জোড়াটি ব্যবহারে কোনো দোষ নেই, কিন্তু বিয়ের পরে দাম্পত্য জীবনের সম্পর্ক বুঝানোর জন্যে কি এই শব্দ জোড়াটি চলে?

বিবাহোত্তর দু’জন মানুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্ণনার ক্ষেত্রে ‘নারী-পুরুষ’ শব্দ জোড়াটি আদতে অকার্যকর। সুতরাং, ‘নারী-পুরুষ’ শব্দ জোড়াটির মাধ্যমে ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দের সঙ্কট নিরসন হচ্ছে না।

পর্ব তিন

বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের সমস্যা হলো তাঁরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য গ্রন্থ আল কোর’আন পড়েন না। যদি পড়তেন, তাহলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এত করুণ দশা আজ আমাদের [পাঠকদের] দেখতে হতো না।

তাঁরা যদি কোর’আন পড়তেন, তাহলে আজ বাংলা সাহিত্য আরো অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধ হতো।

যেমনটা বলেছিলাম, বেগম রোকেয়া ‘স্বামী’ শব্দের সঙ্কট নিরসন করতে পারেননি।

কেন পারেননি?

কারণ, তিনি বাঙালিদেরকে বুঝানোর জন্যে পশ্চিমা সাহিত্যের অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন –

“… শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ বলেন যে, আমাদের সাংসারিক জীবনটা দ্বিচক্র শকটের ন্যায়—ঐ শকটের এক চক্র পতি, অপরটি পত্নী। তাই ইংরাজী ভাষায় কথায় কথায় স্ত্রীকে অংশিণী (‘partner’) উত্তমার্ধ (‘better half’) ইত্যাদি বলে। …আশা করি এখন ‘স্বামী’ স্থলে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দ প্রচলিত হইবে।”

দেখুন, এখানে তিনি পশ্চিমাদের সরাসরি অনুকরণ করে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দটি প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যদি কোর’আন থেকে সমস্যাটি বোঝার চেষ্টা করতেন, এবং উদাহরণ দিতে পারতেন, তাহলে বিষয়টি আরো অনেক সহজ, বোধগম্য ও গ্রহণযোগ্য হত।

যা বলছিলাম,

যে কোনো সাহিত্যে ভালো-মন্দ অনেক শব্দ-ই থাকতে পারে – এটা কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো যখন কোনো শব্দকে অপপ্রয়োগ করা হয়। ‘স্বামী’ শব্দটি এমন একটি শব্দ, যার অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরা নিয়মিতই করে যাচ্ছেন।

দেখুন, ‘স্বামী’ শব্দটি কিন্তু কোর’আনেও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে, বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের মত ‘স্বামী’ শব্দটির কোনো অপপ্রয়োগ করা হয়নি।

অর্থাৎ, একটি সুখী দাম্পত্য জীবন সঙ্গীর জন্যে কোর’আনে ‘স্বামী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি।

কোর’আনের অন্তত পাঁচটি স্থানে ‘স্বামী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যার আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘বাআল’ [بعل]।

‘স্বামী’ শব্দের সঙ্কট বুঝার জন্যে কোর’আনের আয়াতগুলো ভালোভাবে লক্ষ্য করা প্রয়োজন।

দেখুন, কোর’আনে ‘স্বামী’ শব্দটি কিভাবে এবং কি অর্থে ব্যবহার করেছে –

১ – যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং স্ত্রীকে উপেক্ষা করে, এমন ব্যক্তিকে বুঝানোর জন্যে কোর’আনে ‘স্বামী’ বা ‘বাআল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

وَإِنِ امْرَأَةٌ خَافَتْ مِن بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا وَالصُّلْحُ خَيْرٌ وَأُحْضِرَتِ الْأَنفُسُ الشُّحَّ وَإِن تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا

“কোনো স্ত্রী যদি তাহার স্বামীর দুর্ব্যবহার কিংবা উপেক্ষার আশংকা করে, তখন তারা যদি কোনো আপোষ-নিষ্পত্তি বা কোনো মীমাংসা করে ফেলতে চায়, তাহলে তাদের কোনো গুনাহ নেই। মীমাংসা করে ফেলাই শ্রেয়। লোভের কারণে মানুষ স্বভাবতই কৃপণ হয়ে থাকে। যদি তোমরা সৎকর্মপরায়ন ও মুত্তাকী হও, তবে তোমারা যা কর, আল্লাহ তার খবর রাখেন ।” [সূরা ৪/নিসা – ১২৮]

২ – যে ব্যক্তিকে তার স্ত্রী প্রভুর মত সম্মান ও পূজা করে, এমন পুরুষকে বুঝাতে কোর’আনে ‘স্বামী’ বা ‘বাআল’ শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে।

أَتَدْعُونَ بَعْلًا وَتَذَرُونَ أَحْسَنَ الْخَالِقِينَ

“তোমরা কি স্বামীকে (দেবতা হিসাবে) ডাক? এবং সর্বোত্তম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে পরিত্যাগ কর?” [সূরা ৩৭/সাফফাত – ১২৫]

৩ – বৃদ্ধ ও প্রজনন ক্ষমতাহীন ব্যক্তির ক্ষেত্রে ‘স্বামী’ ‘বাআল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

قَالَتْ يَا وَيْلَتَىٰ أَأَلِدُ وَأَنَا عَجُوزٌ وَهَٰذَا بَعْلِي شَيْخًا إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عَجِيبٌ

“সে বলল-কি দুর্ভাগ্য আমার! আমি সন্তান প্রসব করব? অথচ আমি বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছি আর আমার স্বামীও বৃদ্ধ। এটা তো খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার।” [সূরা ১১/হুদ – ৭২]

৪ – যে ব্যক্তি স্ত্রীকে তালাক প্রদান করেছে, তাকে বুঝাতে ‘স্বামী’ বা ‘বাআল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ وَلَا يَحِلُّ لَهُنَّ أَن يَكْتُمْنَ مَا خَلَقَ اللَّهُ فِي أَرْحَامِهِنَّ إِن كُنَّ يُؤْمِنَّ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَبُعُولَتُهُنَّ أَحَقُّ بِرَدِّهِنَّ فِي ذَٰلِكَ إِنْ أَرَادُوا إِصْلَاحًا وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী তিন রজঃস্রাব কাল প্রতীক্ষায় থাকবে। আর যদি সে আল্লাহর প্রতি এবং আখেরাত দিবসের উপর ঈমানদার হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ যা তার জরায়ুতে সৃষ্টি করেছেন তা লুকিয়ে রাখা বৈধ নয়। আর যদি সদ্ভাব রেখে চলতে চায়, তাহলে তাদেরকে ফিরিয়ে নেবার অধিকার তাদের স্বামীরা সংরক্ষণ করে। আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনি ভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর। কিন্তু নারীদের ওপর পুরুষদের মর্যাদা আছে। আর আল্লাহ হচ্ছে পরাক্রমশালী, বিজ্ঞ। [সূত্র: সূরা ২/বাকারা – ২২৮]

দেখুন, উপরোক্ত আয়াতগুলো আল্লাহ তায়ালা ‘স্বামী’ শব্দটির কতটা সচেতন ও সঠিক ব্যবহার করেছেন। একটি সুখী দাম্পত্য জীবনের পুরুষ সঙ্গীকে বুঝানোর জন্যে কোর’আনে কখনো ‘স্বামী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি।


পর্ব চার

কোর’আনকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য বলার অনেক কারণ আছে। যেমন, কোর’আন আমাদেরকে শেখায় – কিভাবে সচেতনভাবে শব্দের প্রয়োগ করতে হয়।

একটি উদাহরণ দিচ্ছি।

বাংলা সাহিত্যে আমরা প্রতিনিয়ত ‘স্ত্রী’ শব্দটি ব্যবহার করি – এতে অবশ্য দোষ নেই। কেননা, ‘স্বামী’ শব্দটি যত সমস্যাজনক স্ত্রী শব্দটি তত সমস্যাজনক নয়।

কোর’আনে ‘স্ত্রী’ শব্দটি বুঝানোর জন্যে ‘ইমরাআ’ [إمرأت ] শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এবং, একটি সুখী দাম্পত্য জীবনসঙ্গিনীর জন্যে ‘যাওজা’ [زوجة] শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

কোর’আনে ব্যবহৃত ‘যাওজা’ শব্দের কোনো বাংলা শব্দ নেই। তাই, আমি এখানে ‘যাওজা’ শব্দের বাংলা অর্থ করেছি – ‘জীবনসঙ্গী’।

বাঙালিরা, বিয়ের আগে ‘জীবনসঙ্গী’ শব্দটি প্রচুর ব্যবহার করলেও বিয়ের পর আর এই শব্দটি ব্যবহার করেন না, তখন ‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দ জোড়াটি ব্যবহার করতে শুরু করেন। অথচ, কোর’আনে দেখবেন, নারী-পুরুষ দু’জন মরে গিয়ে জান্নাতে চলে গেলেও এই ‘জীবনসঙ্গী’ শব্দটা-ই ব্যবহার করা হয়।

আপনি হয়তো আমাকে বলতে পারেন, ‘কথা এত প্যাঁচান কেন?’

আসলে, আপনার কাছে মনে হতে পারে, ‘স্ত্রী’ মানেই তো ‘জীবনসঙ্গিনী’ – শব্দ দুটি তো একই। কিন্তু না। শব্দ দুটির মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে।

কোর’আন থেকে এ বিষয়টি আমরা বুঝার চেষ্টা করব।

একজন পুরুষ বা নারী কারো ‘স্বামী’ বা ‘স্ত্রী’ হবার জন্যে কেবল বিয়ে করলেই চলে। কিন্তু একজন নারী বা পুরুষ কারো ‘জীবনসঙ্গী হবার জন্যে অতিরিক্ত অনেক কিছু প্রয়োজন। ভালোবাসা, বিশ্বাস, সন্তান ও সম্পর্ক – সবকিছু থাকা চাই।

কারো দাম্পত্য জীবনে, নারীটি ভালো কিন্তু পুরুষটি খারাপ হলে, অথবা নারীটি খারাপ কিন্তু পুরুষটি ভালো হলে, কিংবা নারী-পুরুষ উভয়ে খারাপ হলে, সেই পরিবারের নারীটি ‘স্ত্রী’ হতে পারলেও ‘জীবনসঙ্গী’ হতে পারে না। হয় নিজের দোষে, নতুবা পরুষটির দোষে।

কোর’আনে দেখুন, খুবই সচেতনভাবে ‘স্ত্রী’ বা ‘ইমরাআ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

১ – স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ যে নারী, তার জন্যে কোর’আনে ‘স্ত্রী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, ফিরাউনের স্ত্রী আছিয়া। এখানে নারীটি ভালো ছিলেন, কিন্তু পুরুষটি খারাপ ছিলেন।

وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِّلَّذِينَ آمَنُوا امْرَأَتَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِندَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِن فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ

“আল্লাহ মুমিনদের জন্যে ফেরাউনের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। সে বলল: হে আমার প্রতিপালক! তোমার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্যে একটি গৃহ নির্মাণ কর, আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার কর, এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দাও।” [সূরা ৬৬/তাহরীম – ১১]

২ – পুরুষের সাথে বিশ্বাসঘাতিনী নারীকে বুঝানোর জন্যে আল কোর’আনে ‘স্ত্রী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, নূহ এবং লূত (আ)-এর স্ত্রী। এখানে পুরুষেরা ভালো ছিলেন, কিন্তু নারীরা খারাপ ছিলেন।

ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِّلَّذِينَ كَفَرُوا امْرَأَتَ نُوحٍ وَامْرَأَتَ لُوطٍ كَانَتَا تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحَيْنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمَا مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَقِيلَ ادْخُلَا النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِينَ

“আল্লাহ কাফেরদের জন্যে নূহের স্ত্রী ও লূতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। তারা ছিল আমার দুই ধর্মপরায়ণ বান্দার গৃহে। কিন্তু তারা (নূহ ও লূতের) সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ফলে নূহ ও লূত তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারল না এবং তাদেরকে বলা হল: তোমরা উভয়ে জাহান্নামীদের সাথে জাহান্নামে প্রবেশ কর ।” [সূরা ৬৬/তাহরীম – ১০]

৩ – যে নারী নিজ পুরুষকে বাদ দিয়ে অন্য পুরুষের সাথে পরকীয়া করতে ইচ্ছুক, তাকে বুঝাতে কোর’আনে ‘স্ত্রী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, আজিজের স্ত্রী জোলেখা ইউসুফ (আ)-এর সাথে প্রেম করতে চেয়েছিল।

وَقَالَ نِسْوَةٌ فِي الْمَدِينَةِ امْرَأَتُ الْعَزِيزِ تُرَاوِدُ فَتَاهَا عَن نَّفْسِهِ قَدْ شَغَفَهَا حُبًّا إِنَّا لَنَرَاهَا فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ

“শহরের নারীরা বলাবলি করতে লাগল যে, আযীযের স্ত্রী তার যুবক দাস থেকে অসৎ কর্ম কামনা করছে। সে তার প্রেমে উন্মত্ত হয়ে গেছে। আমরা তো তাকে প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে দেখতে পাচ্ছি।” [সূরা ১২/ইউসুফ – ৩০]

৪ – যে দাম্পত্য জীবনে নারী-পুরুষ উভয়ে খারাপ, সে নারীকে বুঝাতে ‘স্ত্রী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, আবু লাহাব ও তার স্ত্রী।

سَيَصْلَىٰ نَارًۭا ذَاتَ لَهَبٍۢ وَٱمْرَأَتُهُۥ حَمَّالَةَ ٱلْحَطَبِ

“অচিরেই (আবু লাহাব) লেলিহান অগ্নিতে প্রবেশ করবে। এবং তার স্ত্রীও – যে ইন্ধন বহন করে।” [সূরা ১১১/লাহাব – ২, ৩]

উপরের আয়াতগুলো থেকে আমরা দেখেছি, দাম্পত্য জীবনে নারী-পুরুষ কেউ একজন কিংবা উভয়ে যদি খারাপ হয়, তখন কোর’আনে ‘জীবনসঙ্গী’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘স্ত্রী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

ধরুন, বিয়ে হয়েছে, ‘জীবনসঙ্গী’ হিসাবে নারী-পুরুষ দু-জনই ভালো। কিন্তু তাদের যদি কোনো সন্তান না থাকে, তাহলে তাদের জীবন অপূর্ণাঙ্গ রয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও কোর’আনে ‘স্ত্রী’ শব্দটি ব্যবহার করেছে।

৪ – যে নারীর সন্তান হয় না, তার ক্ষেত্রে ‘স্ত্রী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ছিলেন ইব্রাহিম (আ)-এর স্ত্রী এবং যাকারিয়া (আ)-এর স্ত্রী।

قَالَ رَبِّ أَنَّىٰ يَكُونُ لِي غُلَامٌ وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا وَقَدْ بَلَغْتُ مِنَ الْكِبَرِ عِتِيًّا

“(যাকারিয়া) বলল: হে আমার প্রতিপালক! কেমন করে আমার পুত্র সন্তান হবে অথচ আমার স্ত্রী যে বন্ধ্যা, আর আমিও যে বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে উপনীত।” [সূরা ১৯/মারইয়াম – ৮]

فَأَقْبَلَتِ امْرَأَتُهُ فِي صَرَّةٍ فَصَكَّتْ وَجْهَهَا وَقَالَتْ عَجُوزٌ عَقِيمٌ

“অতঃপর (ইব্রাহীমের) স্ত্রী চীৎকার করতে করতে সামনে এলো এবং মুখ চাপড়িয়ে বলল: আমি তো বৃদ্ধা ও বন্ধ্যা।” [সূরা ৫১/যারিয়াত – ২৯]

মনে করুন, দাম্পত্য জীবনে নারী-পুরুষ দু’জনই ভালো ছিলেন, তাদের সন্তানও হলো, কিন্তু দু’জন ‘জীবনসঙ্গী’র মাঝে কেউ একজন মারা গেলেন, তখন তো অন্যজন আর ‘জীবনসঙ্গী’ হিসাবে থাকেন না, তাই তার ক্ষেত্রে কোর’আনে ‘স্ত্রী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

৫ – বিধবা নারীর ক্ষেত্রে কোর’আনে ‘স্ত্রী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, ইমরান (আ)-এর স্ত্রী। তিনি ছিলেন মরিয়াম (আ) মা, এবং ঈসা (আ)-এর নানী।

إِذْ قَالَتِ امْرَأَتُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

“স্মরণ কর, যখন ইমরানের স্ত্রী বললো, হে আমার প্রতিপালক! আমার গর্ভে যা রয়েছে আমি তাকে একান্ত তোমার নামে উৎসর্গ করলাম। আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও। নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞাত ।” [সূরা ৩/আলে ইমরান – ৩৫]

উপরের সবগুলো আয়াত থেকে আমরা দেখেছি, একজন ‘স্বামী’ বা ‘স্ত্রী’ হবার জন্যে বিয়ে করলেই চলে। কিন্তু একজন ‘জীবনসঙ্গী’ হবার জন্যে অন্তত দুটি জিনিসের প্রয়োজন।

এক – সুখ-শান্তি, ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও সম্পর্কের ভারসাম্যপূর্ণ একটি মধুর দাম্পত্য জীবন।
দুই – পৃথিবীর ও নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্যে সন্তান উপহার।

বিবাহিত নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি ও ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি না হবার পিছনে অনেক কারণ আছে। মৌলিক কারণ হলো, নারী অথবা পুরুষ – যে কোনো একজনের চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ ও বিশ্বাস যদি অপর জনের সাথে না মিলে, তখন তারা একে-অপরের ‘জীবনসঙ্গী’ হতে পারেন না। বড় জোর একজন ‘স্বামী’ বা ‘স্ত্রী’ হতে পারেন।

এবার আমরা দেখার চেষ্টা করব, কোর’আনে ‘জীবনসঙ্গী’ শব্দটিকে কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

আগেই বলেছি, কোর’আনে ব্যবহৃত ‘যাওজ’ [زوج] শব্দটির কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই। বাংলা ‘জীবনসঙ্গী’ শব্দটির চেয়ে আরবি ‘যাওজ’ শব্দটি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই, কি আর করা? বাংলা ভাষার দৈন্যদশার কারণে আমাকে এই ‘জীবনসঙ্গী’ শব্দটি পছন্দ করতে হলো। মন্দের ভালো আর কি!

কোর’আনে অসংখ্য স্থানে ‘জীবনসঙ্গী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দেখুন।

১ – একজন ‘জীবনসঙ্গী’ মানে একটি ভালোবাসার আকাশ।

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

“তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি হলো, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে ‘জীবনসঙ্গী’ সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি-ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।” [সূরা ৩০/রূম – ২১]

২ – ‘জীবনসঙ্গী’ মানে দুই চোখের মণি।

وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا

“যারা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এমন ‘জীবনসঙ্গী’ ও সন্তান-সন্ততি দান করুন, যারা হবে আমাদের চোখের মণি। এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ করুন।” [ সূরা ২৫/ফুরকান – ৭৪]

৩ – ‘জীবনসঙ্গী’ মানে অফুরন্ত নেয়ামত।

وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ

“হে আদম তুমি এবং তোমার জীবনসঙ্গী জান্নাতে বসবাস কর। সেখান থেকে যা ইচ্ছা খাও তবে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, নতুবা তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।” [সূরা ৭/আরাফ – ১৯]

৪ – ‘জীবনসঙ্গী’ মানে একটি জান্নাতি পরিবেশে।

هُمْ وَأَزْوَاجُهُمْ فِي ظِلَالٍ عَلَى الْأَرَائِكِ مُتَّكِئُونَ

“তারা এবং তাদের জীবনসঙ্গীগণ সুশীতল ছায়ায় সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসবে।” [সূরা ৩৬/ইয়াসিন – ৫৬]

সুতরাং, উপরের সবগুলো আয়াত থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি, আল্লাহ তায়ালা কোর’আনের কিভাবে ‘জীবনসঙ্গী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, এবং কিভাবে ‘স্ত্রী’ বা ‘স্বামী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

একজন ‘জীবনসঙ্গী’ হবার জন্যে দু’জনের চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ ও বিশ্বাসের মিল থাকতে হয়, নিজেরা ভালো হবার চেষ্টা করতে হয়, এবং দাম্পত্য জীবনে পৃথিবীকে সন্তান উপহার দিতে হয়, কিন্তু ‘স্বামী’ বা ‘স্ত্রী’ হবার জন্যে এসব প্রয়োজন হয় না।

আমাদের বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের প্রচুর কোর’আন পড়া প্রয়োজন, এবং শব্দ সচেতন হওয়া উচিত। আমরা চাই – বাঙালি লেখক-কবি-সাহিত্যিকগণ আরো যোগ্যতাসম্পূর্ণ হয়ে উঠুক, এবং বাংলা ভাষাকে তাঁরা আরো অনেক সুন্দর ও সমৃদ্ধ করুক।

One thought on “বাংলা সাহিত্যে “স্বামী-স্ত্রী” সমস্যা, এবং কোর’আনের সমাধান

  1. আসসালামু আলাইকুম,স্যার।
    উত্তমার্ধ শব্দটি বাংলা একাডেমী এবং সংসদ বাংলা অভিধানে না পেয়ে internet এ আসা।আপনার লেখায় শব্দটির অর্থের সাথে পেলাম এক বিরাট সুচিন্তিত আলোচনা।খুব ভালো লাগল লেখাটি পড়ে।
    অ-নে-ক কৃতজ্ঞতা।আশা করি ভালো ভালো আরো লেখা আমাদেরকে পড়ার সুযোগ করে দিবেন।মহান আল্লাহ আপনাকে রহমত দান করুক।

Leave a comment