শিরোনামহীন

বিজ্ঞান বলে হৃদয়ের কথা

একটা মিথ্যা ও বানোয়াট গল্পও যদি বিজ্ঞানের নামে চালিয়ে দেয়া যায়, আধুনিক মানুষরা সেটাকে কোনো প্রশ্ন না করেই বিশ্বাস করে ফেলেন। এমনি একটি কাল্পনিক গল্প, যা বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে চলছে গত ৩০০ বছর ধরে। গল্পটির নাম – ‘মস্তিষ্ক’।

খুব সংক্ষেপে গল্পটা হলো –

“মানুষের একটা ব্রেইন বা মস্তিষ্ক আছে। এই মস্তিষ্ক দিয়ে মানুষ তার যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি, বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই মস্তিষ্ক দিয়েই মানুষ তার চিন্তার কাঠামো তৈরি করে। এবং জীবনের প্রয়োজনে এই মস্তিষ্ক দিয়েই মানুষ বুদ্ধি ও আবেগ উৎপন্ন করে। শরীরের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গ এবং কেন্দ্রবিন্দু হলো এই মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ক-ই হলো শরীরের রাজা, এবং অন্যান্য সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন হৃদয়, কান, চোখ ও চর্ম ইত্যাদি সব হলো মস্তিষ্কের দাশ ও প্রজা।”

গল্পটা এখানেই শেষ না। বাকি অংশ বলছি, তবে তার আগে এই গল্পের একটু ইতিহাস বলে রাখি।

মানব ইতিহাসের শুরু থেকে গত তিন শত বছরের আগ পর্যন্ত জ্ঞানের যত বই-পুস্তক ছিল, কোথাও এমন কোনো কাল্পনিক ও বানোয়াট গল্পের সন্ধান খুঁজে পাওয়া যায় না। যেদিন থেকে পৃথিবীতে ‘আধুনিক বিজ্ঞান’ নামের একটি কুসংস্কার চালু হয়েছে, সেদিন থেকে এই গল্পটা বলা শুরু হয়েছে।

এ গল্পটাকে কেন আমি একটি ‘আধুনিক-কুসংস্কারাচ্ছন্ন-বৈজ্ঞানিক-ভুয়া’ গল্প বলেছি, এবার সে প্রসঙ্গে আসি।

মানব ইতিহাসে জ্ঞানের যত গ্রন্থ ছিল, ধর্মের যত কিতাব ছিল, এবং কবিতা ও সাহিত্যের যত বই ছিল, সব স্থানে লেখা ছিল – “হৃদয় হলো মানুষের চিন্তা ও আবেগের কেন্দ্রবিন্দু। মানুষ হৃদয় দিয়ে চিন্তা করে, এবং মস্তিষ্ক সে চিন্তা বাস্তবায়ন করে।”

কিন্তু, চির সত্য এ কথাটি রাতারাতি পাল্টে যায়, যখন ‘আধুনিক-কুসংস্কারাচ্ছন্ন-বৈজ্ঞানিক’ দৈত্য এসে আমাদের পৃথিবীতে হাজির হয়।

শুরুটা হয় এভাবে –

১৬২৮ সালে, ‘উইলিয়াম হার্ভে’ নামক একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী একটি বই লিখেন। যার নাম – “On the Motion of the Heart and Blood”। বইটা লিখেই তিনি বলতে শুরু করলেন, “আরে, আরে, শুনেছ?… আমি তো হার্টের গোপন রহস্য জেনে গেছি। আমাদের শরীরে তোমরা যে রক্ত দেখছ না? এ রক্ত কিন্তু এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকে না। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের হার্ট এই রক্তগুলোকে একবার নিজের কাছে নিয়ে যায়, এরপর আবার ছেড়ে দেয়।”

উইলিয়াম হার্ভে যখন এ কথাগুলো বলছিলেন, তখনো কিন্তু তৎকালীন বিজ্ঞান বিশ্বাস করতো যে – “হার্ট বা হৃদয় হলো মানুষের চিন্তা ও আবেগের কেন্দ্রবিন্দু। এবং মস্তিষ্ক হলো সেই চিন্তার বাস্তবায়নকারী।”

এরপর, ১৭৬০ সাল থেকে শুরু হলো শিল্প বিপ্লব। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সাথে তৎকালীন জ্ঞানী মানুষদের চরম দ্বন্দ্ব চলছিলো। দ্বন্দ্বের কারণ হলো, খ্রিস্টান পাদ্রীরা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ ইঞ্জিলকে অনেক আগেই পরিবর্তন করে ফেলায়, ১৭০০ সালের দিকে এসে বাইবেল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও সাধারণ একটি বইতে পরিণত হয়েছিল। ফলে জ্ঞানী মানুষেরা ধর্ম থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন।

জ্ঞানী মানুষদের মধ্যে যারাই খ্রিস্ট ধর্ম থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো, তারাই গিয়ে তখন শিল্প বিপ্লব, যন্ত্র ও মেশিনের জয়গান গাইতে শুরু করলো। এবং ঠিক সেই সময়টিতেই ‘আধুনিক বিজ্ঞানের’ যাবতীয় বই-পুস্তক লেখা হচ্ছিল। তখন সবাই সবকিছুকে মেশিনের মত চিন্তা করতো। একসময়, মানুষ নিজেকেও একটা মেশিন হিসাবে ভাবতে শুরু করলো। এবং এক পর্যায়ে কিছু চিকিৎসা বিজ্ঞানী বলতে শুরু করলেন যে –

“হার্ট একটি পাম্প মেশিন ছাড়া আর কিছুই নয়। রক্ত সঞ্চালন করাই কেবল হার্টের কাজ, এর বেশি কিছু হার্ট করতে পারে না। মানুষের চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ এগুলো হার্টের কাজ নয়, এগুলো সবকিছু-ই মানুষের মস্তিষ্কের কাজ। এখানে হার্টের কোনো গুরুত্ব নেই। অতীতের ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের যত গ্রন্থ আছে, সবই ভুল।”

আসলে কি তাই? প্রকৃত অর্থে, তৎকালীন ‘আধুনিক বিজ্ঞানীরা’ নিজেরাই নিজেদের ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন-বৈজ্ঞানিক-ভুয়া’ গল্পটি লেখায় তখন এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, সত্য কি তা বুঝতে পারেননি।

এরপর,

সেই যে এ গল্পের শুরু হলো, আজো চলছে। গত তিন শত বছর পার হয়ে গেল, ‘আধুনিক মানুষেরা’ এ কুসংস্কার থেকে আজো মুক্তি পেল না। তবে আশার কথা হলো – গত ২০ বছর থেকে, ‘মস্তিষ্ক’ নামক এই গল্পটিকে ভুয়া ও কুসংস্কার বলে প্রমাণ করছেন বিশ্বের প্রথম সারির সত্যান্বেষী বিজ্ঞানীরা।

পশ্চিমা বিশ্বের কিছু সত্যান্বেষী বিজ্ঞানীও আজ নিজেদের ভুল বুঝতে পারছেন। তারা বলতে শুরু করেছেন যে, “হার্ট হলো মানুষের শরীর, চিন্তা ও অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু। চিন্তা ও অনুভূতির ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের চেয়েও হার্ট অনেক বেশি প্রভাবশালী। এবং হার্ট যা নির্দেশ দেয়, মস্তিষ্ক তা বাস্তবায়ন করে।”

যেসব বিজ্ঞানীরা আমাদের বর্তমান সময়ে হার্ট ও মস্তিষ্কের প্রকৃত এ সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, আমার জানা মতে তাদের কয়েক জনের নাম এখানে তুলে দিলাম।

1.Dr. Joe Dispenza 2. Gregg Braden 3. Deepak Chopra 4. Howard Martin, 5. Dr. Jane Goodall, 6. Eckhart Tolle, 7. Gary Zukav, 8. Rollin McCraty, 9. Ruediger Schache, 10. Dean Shrock

উপরে যেসব বিজ্ঞানীদের নাম লিখলাম, এদের সবার-ই নিজস্ব গবেষণা মূলক বই এবং অনলাইনে নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে। এছাড়াও, অনলাইনের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে হার্টের কার্যক্ষমতা নিয়ে প্রচুর একাডেমিক গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক রিসোর্স পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ একজন বিশ্ববিখ্যাত হার্ট বিশেষজ্ঞের কথা আমি এখানে উল্লেখ করছি।

ডা. রলিন মক্রেডি – একজন হার্ট বিশেষজ্ঞ। আধুনিক-বৈজ্ঞানিক-কুসংস্কার থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছেন, এবং তিনি এখন সত্য বিজ্ঞানের পথে চলছেন। তথাকথিত ‘মূলধারার’ বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্তিকর চিন্তার বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেন। কিন্তু তাই বলে ‘মূলধারার’ বিজ্ঞান তাকে অবজ্ঞা করতে পারে না কখনও। কারণ, মূলধারার বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত জার্নালগুলোতে তিনি নিয়মিত তার গবেষণা-প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন।

ডা. রলিন মক্রেডি-র গবেষণা সংস্থার নাম “The Heart-Math Institute”। এ সংস্থা থেকে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয় “American Journal of Cardiology” –তে।

গবেষণাটির সারসংক্ষেপ ছিল এমন –

হার্ট ও ব্রেইনের মাঝে সম্পর্ক কি? এবং হার্ট ও ব্রেইন প্রত্যেকে কে কি কাজ করে? –এটা বুঝার জন্যে ডা. রলিন মক্রেডি ৩০ জন সুস্থ মানুষকে তার ল্যাবরেটরিতে নিয়ে এসে একটি গবেষণা করেন। প্রত্যেকের হার্টের EKG এবং ব্রেইনের EEG পরীক্ষা করার জন্যে তাদেরকে প্রস্তুত করেন। এরপর প্রত্যেকের সামনে একটি করে কম্পিউটার প্রদান করেন। কম্পিউটারে কিছুক্ষণ পরপর বিভিন্ন ছবি আসতে থাকলো। কিছু ছবি ছিল খুবই ভয়ঙ্কর, কিছু ছবি ছিল মানুষ হত্যার, এবং কিছু ছবি ছিল দেখতে খুবই সুন্দর; –এভাবে নানান রকমের ছবি তাদেরকে দেখতে দেয়া হলো। কেউ আগ থেকে জানতো না, কোন ছবির পর কোন ছবিটি আসবে। এভাবে তাদের প্রত্যেককে দুইবার করে পরীক্ষা করা হলো।

এই গবেষণাটি থেকে অনেকগুলো তথ্য সংগ্রহ করেন ডা. রলিন মক্রেডি। তিনি প্রমাণ করেন যে,

১. ভয়ঙ্কর ছবি গুলো দেখার পর সর্বপ্রথম হার্ট বিটের তারতম্য ও অস্থিরতা ঘটে। তারপর হার্ট নিজ থেকে মস্তিষ্কে সিগনাল পাঠায়। এবং এরপর মস্তিষ্ক থেকে সে সিগনাল সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

অন্যদিকে, মনোরম ছবিগুলো দেখার পর প্রথমে হার্ট বিটের স্থিরতা আসে, তারপর মস্তিষ্কে সিগনাল যায় এবং এরপর তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

২. কোনো কিছু দেখার পর চোখ সর্বপ্রথম হার্টকে সিগনাল পাঠায়, হার্ট খুব দ্রুত মস্তিষ্কে সিগনাল পাঠায়, এবং মস্তিষ্ক সাথেসাথেই সে সিগনালটি সারা শরীরে পাঠিয়ে দেয়। এ কাজগুলো সম্পন্ন হয় খুবই দ্রুত গতিতে।

৩. মস্তিষ্কের মতই হার্টের একটি নিজস্ব ও শক্তিশালী নিউরন সিস্টেম আছে। আমাদের হার্টে ১০ হাজারেরও অধিক নিউরন লাইন রয়েছে।

৪. হার্টের নিজস্ব একটি ব্রেইন রয়েছে।

৫. হার্টের ইলেকট্রিক্যাল ফিল্ড (EKG) হলো মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল ফিল্ড (EEG) থেকে ১০০ গুন বেশি শক্তিশালী। এবং, হার্টের ম্যাগনেটিক ফিল্ড হলো মস্তিষ্কের ম্যাগনেটিক ফিল্ড থেকে প্রায় ৫ হাজার গুন বেশি শক্তিশালী।

এ ধরেন আরো অসংখ্য তথ্য দিয়ে ডা. রলিন মক্রেডি প্রমাণ করেন যে – “আমাদের চিন্তা ও অনুভূতি তৈরির ক্ষেত্রে হার্ট মস্তিষ্ক থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী।”

দুঃখের বিষয় হলো, এ সত্য তথ্যগুলো ‘আধুনিক-কুসংস্কারাচ্ছন্ন-বিজ্ঞানের’ কোনো পাঠ্য বইতে আপনি খুঁজে পাবেন না। কিন্তু সুখের বিষয় হলো, এ তথ্যগুলোর সাথে আপনি সম্পূর্ণ মিল পাবেন আমাদের পাঠ্যপুস্তক আল-কোর’আনে। আল্লাহ বলছেন –

أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَتَكُونَ لَهُمْ قُلُوبٌ يَعْقِلُونَ بِهَا أَوْ آذَانٌ يَسْمَعُونَ بِهَا فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَلَٰكِن تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ ﴿الحج: ٤٦﴾

তারা কি এই উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণ করেনি, যাতে তারা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারে? বস্তুত: চক্ষু তো অন্ধ হয় না, বরং বক্ষস্থিত অন্তরই অন্ধ হয়। [ সূরা ২২/হাজ্জ – ৪৬]

3 thoughts on “বিজ্ঞান বলে হৃদয়ের কথা

  1. their research is correct but understanding is wrong.
    brain receive signal from eye, then brain send respond to the Adrenalin gland(kalb), then Adrenalin gland(kalb) and this reaction spread to the whole body including brain. so Adrenalin gland(kalb) do not think but it can react.

Leave a comment